মোশারফ হোসেন ॥ বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সার্ভিসেস এন্ড ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার (এস এফসি) প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি। এই ধীর গতির কারণে নষ্ট হতে পারে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। তাঁত বোর্ড আধুনিক করণের জন্য ২০১৬ সালে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ দিয়ে শুরু হয়। কাজের মেয়াদ ছিল ৩ বছর। ২০১৯ সালে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সমাপ্তি হাওয়ায় কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়নি।
কুষ্টিয়া কুমারখালীর উপজেলার ১৯৬৫ সালে গড়াই নদীর পাড়ে অবস্থিত কুমারখালী তাঁত বোর্ড। এই তাঁত বোর্ড কে আধুনিক করণের জন্য এই প্রকল্প চালু হয়।
প্রায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে (কালিহাতি, টাঙ্গাইল, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, কুমারখালী) স্থাপন করা হচ্ছে তাঁত শিল্পের আধুনিক করণের কাজ।
তার মধ্যে কুমারখালী তাঁত বোর্ডে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নত পরিবেশে তাঁতি এবং তাঁতি পরিবারের অন্যান্য নাগরিক সুযোগ সুবিধা প্রদান; দরিদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদের পুনর্বাসন; তাঁতিদের দক্ষতা বৃদ্ধি, বয়নপূর্ব ও বয়নোত্তর সেবা প্রদান এবং উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন; তাঁতিদের ন্যায্য মূল্যে সুতা ও কাঁচামাল সরবরাহ করা; উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণে সহায়তা প্রদান; দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে তাঁত বস্ত্র সরবরাহ; এবং তাঁতিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।এস্টাবলিশমেন্ট অব থ্রি হ্যান্ডলুম সার্ভিস সেন্টারস ইন ডিফারেন্ট।
দেশের তাঁত অধ্যুষিত এলাকায় তাঁতিদের বয়নপূর্ব ও বয়নোত্তর সেবা যেমন-কাপড় রংকরণ, মার্সারাইজিং, সাইজিং, ক্যালেন্ডারিং, স্টেন্টারিং, ফোল্ডিং ইত্যাদি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ৩টি সার্ভিস সেন্টার (কালিহাতি, টাঙ্গাইল, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, কুমারখালী) স্থাপন করা হচ্ছে।
প্রকল্প এলাকা এবং আশে পাশের প্রায় ১.৪০ লক্ষ তাঁতি বয়নপূর্ব ও বয়নোত্তর বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারবে।
কেন্দ্রসমূহের সার্ভিসিং ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ ৩টি কেন্দ্র হতে মোট ৪৫.০২ লক্ষ কেজি সুতা রংকরণ এবং ২৫.২২ কোটি মিটার কাপড়ে সার্ভিস প্রদান সম্ভব হবে।
তাঁত সংশ্লিষ্টদের মতে, এই প্রকল্পের সুবিধা হলো, কাপড় উৎপাদনে ত্রুটির হার হ্রাস পাবে এবং গুণগতমানসম্পন্ন কাপড় উৎপাদিত হইবে।
তাঁতশিল্পের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে ধীরগতি বিরাজ করছে। এতে এ শিল্পের উন্নয়ন একদিকে যেমন থমকে আছে, অন্যদিকে সম্ভাবনাময় খাতটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ খাতের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত প্রকল্পটিও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
কুমারখালী ও আশপাশের উপজেলার তাঁতিদের জন্য রং, মাকু ও সুতা, তাঁতের অন্যান্য জিনিসপত্র চাহিদা পূরণ করা এবং এলাকার বেকার জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু যাদের জন্য প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই তাঁতিরা এখন পর্যন্ত কোনো সুফল পাননি। প্রকল্পের ২ বছর পার হলেও শুরু হয়নি এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। বছরের পর বছর অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থেকে মরিচা ধরছে সেন্টারের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতিতে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্মিত আবাসিক ডরমেটরিসহ ভবনগুলোর গায়ে শ্যাওলা পড়েছে।
এলাকার তাঁতিদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে প্রায় ৫০/ ৬০ হাজার হাত তাঁত ছিল। বিদ্যুৎ চালিত তাঁত ৬০ হাজার প্রায়। প্রতি বছর ২শ’ ৬০ কোটি টাকা মূল্যের কাপড় তৈরি হত এ জেলায়। ২ কোটি ৮৮ লাখ পিস লুঙ্গি, ১৫ লাখ পিস বেডকভার, ৭২ লাখ পিস গামছা তোয়ালে উৎপাদন হত। এক সময় এ জেলায় বস্ত্রশিল্পের বার্ষিক আয় ছিল ৩শ’ কোটি টাকার উপরে। দেশের মোটা কাপড়ের চাহিদার ৬৩ ভাগ পূরণ করতো কুষ্টিয়ার তাঁতীরা। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ তাঁত কাপড়ের ছিল ব্যাপক চাহিদা। বর্তমানে এ চাহিদা কমে ২৫ ভাগে নেমে এসেছে। সব কিছুর দাম বাড়লেও আশানুরুপ তাঁতবস্ত্রের কোন দাম না বাড়ায় কুষ্টিয়ার ১ লাখ ১৪ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৫০ হাজার তাঁত শ্রমিক পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখনও পুরাতন পেশা হিসেবে এ পেশায় টিকে আছে কয়েকহাজার শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু কালের পরিবর্তনে তা আজ বিলুপ্তির পথে। ক্রমাগত লোকসান, পুঁজির অভাব, দফায় দফায় কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে থমকে গেছে উপজেলার তাঁতশিল্পীদের জীবনের স্বাভাবিক গতি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নির্মিত বিশাল আকারের তাঁত বোর্ড ফ্যাসিলিটিজ সেন্টারটি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে।
তাঁতি নেতা আজিজুল হক বলেন, আমরা বেশ কয়েকবছর ধরে দেখছি এই মেশিনগুলো খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছে, এই মেশিনগুলো সেট করতে হলে বাইরে থেকে লোক আনতে হবে" বাইরে থেকে লোক আনবে কবে আর মেশিন গুলো সেট হবে কবে জানিনা। এই মেশিনগুলো ধীরে ধীরে ঘুনে খেয়ে ফেলবে অথবা মাটিতে নষ্ট হয়ে যাবে।
তাঁতি আনিসুল রহমান জানান, কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি এনে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আমাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে ।
কাপড় ব্যবসায়ী নিশান বলেন, আমাদের সামনে যে মেশিন গুলো দেখছেন প্রায় ৩৫/৩৬ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। এখন পর্যন্ত মেশিন গুলো রাখবার বিল্ডিং বুঝে পাইনি তাঁত বোর্ড। তাহলে এই প্রকল্প আদেও বাস্তবায়ন হবে কি- না তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাসুদ রানা বলেন, কুমারখালী তাঁত বোর্ড ১৯৬৫ সালে শহীদ গোলাম কিবরিয়া পরামর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের তাগিদে নতুন টেকনোলজি কে কাজে লাগিয়ে কুমারখালী বিসিক কে আধুনিক করার লক্ষ্যে ২০ ১৬ সালে টেন্ডারের মাধ্যমে বিসিক কে আধুনিক করণের কাজ শুরু হয়। আমরা হতাশ এখন পর্যন্ত বিল্ডিংটি হস্তান্তর হয়নি। এটা অত্যন্ত হতাশার কথা সবারই উন্নত হয় কিন্তু আমার তাঁতিদের কোন উন্নত হয় না। পাঁচ মাস যাবত কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে নষ্ট হচ্ছে। এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে অনেক অফিসার বেতন নিচ্ছেন, আসে গাড়ি করে, প্যান্ট পড়ে, কিন্তু আমার তাঁতিরা সারাজীবন লুঙ্গি পড়েই তাদের জীবন কেটে গেল। কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর দায়ভার কে নেবে। আমরা চাই আমলাতন্ত্র জটিলতা কাটিয়ে যথাযথ সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
কুমারখালী তাঁত বোর্ড এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান বলেন, কুমারখালী বিসিক কে আধুনিক করণের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ দিয়ে শুরু হয় । করোনার সময় কাল প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। গণপূর্ত থেকে বিল্ডিংটি বুঝিয়ে দেয়া হয়নি আমাদের। থ্রি হ্যান্ডলুম সার্ভিস সেন্টারের জন্য যে জায়গা প্রয়োজন, সেই জায়গা করতে একটু দেরি হচ্ছে। এখন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অচিরেই আমরা পুরো প্রকল্প চালু করতে না পারবো বলে আশা করি। কিছু দিনের মধ্যেই হ্যান্ডলুম মেশিন চালু করতে পারবো বলে আশা করছি।
0 Comments