Random Posts

সম্পদের বিবরণী হিসাব দিতে অনীহা সরকারি চাকরিজীবীদের

 

‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান। কিন্তু ৪৩ বছর আগের এই বিধানকে মানছেন না সরকারি চাকুরেরা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের পর বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে সরকারি চাকুরেদের সম্পদের হিসাব দিতে গত বছর জুনে সব মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতেও টনক নড়েনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। যথারীতি অন্যান্য বছরের মতো গত বছরও (২০২১) হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা দেননি তাদের সম্পদের হিসাব। এমন পরিস্থিতিতে সম্পদের হিসাব দিতে আবারও তাগিদ দিয়ে  সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি ১৩-তে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করবেন। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার, সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বীমা পলিসি এবং ৫০ হাজার টাকা বা ততধিক মূল্যের অলঙ্কারাদিসহ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দেবেন। কিন্তু এমন বিধান মানছেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এত দিন সরকারেরও এ বিষয়ে কোনো তদারকি ছিল না। বর্তমান মেয়াদে সরকার গঠনের ১০ দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় দুর্নীতি বন্ধে সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধে কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টিও ছিল। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের পর সম্পদ বিবরণী দাখিল ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির নিয়ম মানতে সব মন্ত্রণালয়ে গত বছরের ২৪ জুন চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে নতুন বছরের দুই মাস অতিবাহিত হলেও নির্দেশনা বাস্তবায়নের দেখা মেলেনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষে সচিবালয়ের অন্তত ১২টি মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব, জনপ্রশাসনে দু-তিনজন উপসচিব ও যুগ্ম-সচিব, তিন-চারজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং দু-তিনজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৪-৫ জন কর্মচারী তাদের হিসাব বিবরণী জমা দিয়েছেন। অন্যান্য মন্ত্রণালয়-বিভাগেরও দু-একজনের বেশি কেউই হিসাব দেননি।

এ প্রেক্ষাপটে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার তাগিদ দিয়ে সব মন্ত্রণালয়ে আবারও চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, “সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর আওতাভুক্ত সব সরকারি কর্মকর্তা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে সম্পদ বিবরণী দাখিল, ওই সম্পদ বিবরণী ডাটাবেজ তৈরি ও নিয়ন্ত্রণকারী সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে স্থাবর সম্পত্তি অর্জন/বিক্রির বিষয়ে ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’-এর ১১, ১২ ও ১৩ বিধি প্রতিপালনপূর্বক এ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে পুনরায় অনুরোধ করা হলো।” এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রশাসন বিষয়ক কলামিস্ট আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বারবার কেন তাগিদ দিতে হবে। সরকারি চাকরি করলে অবশ্যই সরকারের এ-সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ফলে সরকারি সব কর্মচারীকে আইন ও বিধিবিধান মেনে চলা উচিত।’ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগে প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করাকেই অজুহাত দেখাচ্ছেন সরকারি চাকুরেরা। একাধিক কর্মচারী বলেন, ‘প্রতি বছরই আয়কর রিটার্ন জমা দিই। সেখানেই সম্পদের তথ্য থাকে। সুতরাং আলাদা করে হিসাব দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। তবু প্রতিটি দফতর/সংস্থার প্রধান চাইলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিতে বাধ্য। কিন্তু শীর্ষ কর্মকর্তারাই এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেন না। ফলে কেউই হিসাব দিতে আগ্রহী হন না।’ এই অজুহাত উড়িয়ে দিয়ে প্রশাসন বিষয়ক একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘সরকার চাইলে কর্মচারীরা সম্পদের হিসাব দিতে বাধ্য। যারা সরকারের নির্দেশ অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। দু-একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সবাই তখন সম্পদের হিসাব দেবেন। প্রয়োজনে কর্মচারীদের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যের সম্পদের হিসাবও নিতে হবে। এ ছাড়া সম্পদের হিসাব না দিলে কী শাস্তি হবে তাও নির্দিষ্ট করতে হবে।’

তবে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভুইঞা। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে প্র্যাকটিস না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একবার সম্পদের হিসাব দেওয়া শুরু হলে সবাই তখন দেবেন।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে সরকারি কর্মচারীরা আয়কর রিটার্ন জমা দিতেন না। পরে এ বিষয়ে নির্দেশনার পর এখন কিন্তু সবাই নিয়মিত আয়কর জমা দিচ্ছেন। তবে এই সম্পদের তথ্য যাচাই-বাছাই একটি জটিল প্রক্রিয়া। এটা অনলাইনে জমা দেওয়ার বিধান করলে ভালো হবে। এতে সম্পদের হিসাব কে দিল, কে দিল না তা চিহ্নিত করাও সহজ হবে। আবার এসব তথ্য সরকারকে অবশ্যই সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।’ উল্লিখিত বিষয়ে বক্তব্য জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজমকে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে এসএমএস করা হলেও তাতে সাড়া দেননি সচিব। তবে এ বিষয়ে গত নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার ডেডলাইন। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখব। এর পরই সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়া হবে। চাকরিতে প্রবেশের সময় সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন সেটাকে ভিত্তি ধরে যাচাই-বাছাই করা হবে। এবার যারা হিসাব দেবেন তাদের তালিকা করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী তারা পাঁচ বছর পর আবার হিসাব জমা দেবেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে সবাইকে হিসাবের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

Post a Comment

0 Comments